অন্ধকার ফুঁড়ে আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। হতাশ্বাসের ধূলিকণা উড়ে যাচ্ছিল দূর দিগন্তে। ফুটবলের উঠোনে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছিল। এবার সে অন্ধকার অনেকটাই দূরীভূত হয়ে গেল মেয়েদের উজ্জ্বল হাসিতে। ব্যর্থতার মালা গাঁথতে গাঁথতে ক্লান্ত পথিক এবার সাফল্যের গৌরবে দীপ্ত হলো। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ালেন সাবিনা খাতুনরা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষ হলো সাফের ট্রফি হাতে। ছেলেদের হাত ধরে সাফের ট্রফি এসেছিল ২০০৩ সালে। উনিশ বছরের আক্ষেপ ঘুচালো মেয়েরা। গতকাল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে সাফের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের মুখোমুখি হন সাবিনা খাতুনরা। টুর্নামেন্টজুড়ে যেমন আধিপত্য দেখিয়েছেন, তেমনি ফাইনালটাও খেললেন। দুঃসাহসে ভর করে নিজেদের উজাড় করে দিলেন। বৈরী আবহাওয়া আর প্রতিপক্ষ দলের হাজার হাজার সমর্থকের গর্জনকে উপেক্ষা করে ছিনিয়ে আনলেন কাক্সিক্ষত জয়। ৩-১ গোলের জয়ে রঙ্গশালা রাঙিয়ে দিলেন গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ পেল নতুন চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়ন লাল-সবুজের বাংলাদেশ। চার পাশে বৈরী পরিবেশ। বৃষ্টির পানি জমে মাঠ কর্দমাক্ত। সে মাঠে বল নিয়ে ছুটে চলাই কঠিন! গতি বাড়ালেই হুমড়ি খেয়ে পড়ার ভয়। কয়েক মিনিট পরই কর্দমাক্ত ফুটবলারদের মধ্যে শত্রু-মিত্র চেনা দায় হয়ে পড়ল। গ্যালারির এক প্রান্তে থাকা গুটি কয়েক বাংলাদেশি সমর্থক হাজার হাজার নেপালি দর্শকদের কাছে কোণঠাসা হয়ে থাকলেন ম্যাচজুড়ে। গ্যালারির মুহুর্মুহু গর্জন ছিল সাবিনাদের বড় প্রতিপক্ষ। কিন্তু কোনো কিছুকেই পাত্তা দিলেন না সাবিনারা। সব ভয়-শঙ্কা উড়িয়ে ছুটলেন বিজয়ের পথ ধরে। মাঠের লড়াইয়ে নেপালকে হারালেন। বৈরী পরিবেশকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নিলেন একের পর এক গোল করে। হাজার হাজার নেপালি দর্শক স্তম্ভিত হয়ে দেখল বাংলার বাঘিনীদের বিদ্যুৎ গতি। শুনল বাংলার বাঘিনীদের কান ফাটানো গর্জন। গ্যালারির গুটিকয়েক দর্শক বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলশিল্প।
নেপাল কঠিন প্রতিপক্ষ। কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জুতসই কৌশলটাই নিয়েছিলেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। জমাট বাঁধা ডিফেন্স আর ক্ষুরধার আক্রমণভাগের ওপর আস্থা রাখেন তিনি। নেপালের আক্রমণ রুখে দেন আঁখি আর মাসুরা পারভিনরা। অন্যদিকে মারিয়া মান্ডা আর মনিকা চাকমারা মাঝ মাঠে সাপ্লাই লাইনের কাজ করেন। আক্রমণভাগে সাবিনা-শামসুন্নাহার জুনিয়রর আর কৃষ্ণা রানী সরকাররা হয়ে উঠেন উত্তপ্ত গোলা বারুদ। সুযোগ পেলেই যেন ফুটে উঠবেন! শামসুন্নাহার জুনিয়রই প্রথম গোল উপহার দেন বাংলাদেশকে। সিরাত জাহান স্বপ্নার পরিবর্তে ১০ মিনিটে মাঠে নামেন তিনি। বদলি হিসেবে মাঠে নামার তিন মিনিটের মধ্যেই গোল করে দলকে এগিয়ে দেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। ডি বক্সের ডান পাশ থেকে মনিকা চাকমার ক্রসে ছোটো ডি বক্সের ভিতর থেকে ডান পায়ের শটে গোল করেন তিনি। ম্যাচের ৪১ মিনিটে নেপালের ডিফেন্ডারদের ভুলে বল পেয়ে ডি বক্সে বাড়িয়ে দেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ডি বক্সের ভিতর থেকে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে গোল করেন কৃষ্ণা রানী সরকার। ম্যাচের ৭০ মিনিটে অনিতা বাসনেট নেপালের পক্ষে একটি গোল শোধ দিলেও ৭৭ মিনিটে কাউন্টার আক্রমণ থেকে গোল করে ব্যবধান ৩-১ করেন কৃষ্ণা রানী।টুর্নামেন্টজুড়েই গোলরক্ষক রূপনা চাকমা গোলবারের সামনে ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। ফাইনালে নেপালের বেশ কয়েকটি আক্রমণ তিনি রুখে দেন। বিশেষ করে ম্যাচের ৩৬ মিনিটে অনিতার ফ্রি কিক শটটা রুখতে গিয়ে পাখির মতো উড়ে যান তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে কেবল একটাই গোল হজম করেছেন তিনি। টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হয়েছেন রূপনা চাকমা। টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড় হয়েছেন সাবিনা খাতুন। বাংলাদেশের অধিনায়ক সাবিনা সেরা গোলদাতাও হয়েছেন। ফেয়ার প্লে ট্রফিও পেয়েছে বাংলাদেশ।
ভারতের মতোই নেপালের বিপক্ষে আগে কখনো জিততে পারেনি বাংলাদেশের মেয়েরা। ভারতকে প্রথম হারের তিক্ত স্বাদ গ্রুপ পর্বেই দিয়েছেন মেয়েরা। এবার প্রথমবারের মতো হারাল নেপালকেও। তাও ফাইনালে! নেপালের বিপক্ষে এর আগে আটবার খেলে ছয়বারই হেরেছে বাংলাদেশ। ড্র করেছে দুইবার। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ একবারই ফাইনাল খেলেছে। ২০১৬ সালে সেই ফাইনালে ভারতের কাছে পরাজিত হন সাবিনারা। নেপাল গতকালের আগে আরও চারবার সাফের ফাইনাল খেলেছে। প্রতিবারই ভারতের কাছে হেরেছে তারা। গতকাল দুই দলেরই সুযোগ ছিল নতুন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। নেপালের মেয়েদের কাঁদিয়ে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে শিরোপার স্পর্শ পেল বাংলাদেশ।