লোকসমাজ ডেস্ক॥ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ শুরু করেন তিনি। এ অর্থমন্ত্রীর টানা পঞ্চম এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বাজেট এটি।
বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারের সাথে মিল রেখে একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে দেশকে চালিত করতে এবং ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে বাজেটে।
প্রস্তাবিত বাজেটের যে আকার ধরা হয়েছে, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫.২ শতংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.২ শতাংশ। রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেছেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, চলতি হিসাবের ভারসাম্য উন্নয়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার হার স্থিতিশীল করা দেশের অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, আমাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, চলতি হিসাবের ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার হার স্থিতিশীল করা।’
তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে টেকসই উত্তরণ এবং উত্তরণ-পরবর্তী বাস্তবতা মোকাবেলার কৌশলগুলো এখনই নির্ধারণ করা দরকার। বিশেষ করে শুল্ক যৌক্তিককরণ, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ, ভর্তুকি/নগদ সহায়তা প্রত্যাহার বা বিকল্প অন্বেষণ ইত্যাদি এখন বিবেচনা করা উচিত।
তিনি উল্লেখ করেন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় মেটাতে এবং প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা করার জন্য জিডিপির শতাংশ হিসাবে রাজস্বের পর্যাপ্ত প্রবৃদ্ধি, সরকারি ব্যয়ের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় অর্থায়ন সহজতর করা এবং দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা সম্পর্কে আপনাদেরকে ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য আমরা একটি কৌশল প্রণয়ন করছি।
বাজেট বক্তৃতার সাথে থাকে মধ্যমেয়াদী নীতি কৌশল সম্বলিত ‘মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি (এমটিএমপিএস)’।
তিনি বলেন, এই নীতি বিবৃতি আমাদের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনা করে মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যগুলোকে ব্যাখা করে।
এদিকে বাজেট প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দেশকে সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
গতকাল সংসদ ভবনের সামনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকান। কোনো দেশই এত ভালো নয়। ইউরোপ, আমেরিকা… এমনকি আমাদের প্রতিবেশীদের দিকেও তাকান, তারা কি ভালো করছে? আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছি।’
ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, এই বাজেটও ‘জনবান্ধব’ বাজেট।
তিনি আরো বলেন, জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য বাজেট তৈরি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি জনবান্ধব বাজেট। সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখেই এই বাজেট করা হয়েছে।’
অপরদিকে প্রস্তাবিত বাজেটকে লুটপাট অর্থ পাচারের জন্য স্মার্ট বাজেট আখ্যা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পৃষ্ঠপোষকতার অর্থনীতি গড়ে তুলছে। লুটপাট, অর্থ পাচারের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট নিঃসন্দেহে স্মার্ট।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে বনানীতে তার নিজের বাসায় জাতীয় বাজেট প্রস্তাবের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন আমীর খসরু।
তিনি বলেন, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট সরকার দিচ্ছে নাকি আইএমএফ দিচ্ছে তা দেখতে হবে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী তাদের বাজেট দিলে সরকার লুটপাট করতে পারবে না, আর যদি আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী বাজেট না করে সে ক্ষেত্রে আইএমএফের সাপোর্ট পাবে না।’
আমীর খসরু বলেন, ‘ভাড়া, চাঁদা আর কমিশনভিত্তিক অর্থনীতি করছে সরকার। যার দায়ভার জনগণকে দিতে হচ্ছে। সব প্রতিষ্ঠানকে লুটপাটে পরিণত করেছে। আওয়ামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে স্মার্টলি লুটপাটের জন্য বাজেট দিয়েছে সরকার। বড় আকারের বাজেট দিয়ে মূলত ঋণ নিয়ে ঘি খাচ্ছে সরকার, এর বোঝা জনগণকে বহন করতে হবে। ৫২ শতাংশ ঋণ বেড়েছে গত সাত বছরে, যার দায় বইতে হবে আগামী প্রজন্মকে।’
তিনি বলেন, ‘৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্রতার মধ্যে আছে, নতুন করে আরো দরিদ্র হচ্ছে। ঢাকায় নতুন দরিদ্র হয়েছে ৫২ শতাংশ। আওয়ামী লীগের অর্থনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা লাভবান হবে, জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আওয়ামী লীগের লুটপাটের এ বাজেটে অর্থনীতি বিপাকে পড়েছে, দেশের জনগণ বিপদে পড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে। অনেক মানুষ এক বেলা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তাদের স্বাস্থ্যসেবা সীমিত করেছে। যারা ধনী হচ্ছে তাদের কর দিতে হচ্ছে না।’
বিএনপির সিনিয়র এ নেতা বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য কমাতে গেলে সরকারকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, টাকার মান বাড়াতে হবে ডলারের বিপরীতে। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। না হলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, আগামীতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য জনগণ আগ্রহী হয়ে আছে সেখানে তারা এর জবাব দেবে।
চলমান সংকট সমাধানের পথরেখা নেই : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
নির্বাচনকালীন বাজেট হিসেবে এটি কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না। অর্থনীতিতে চলমান সংকট সমাধানের জন্য কোনো সুস্পষ্ট পথরেখা এই বাজেটে দেওয়া হয়নি। আমদানী নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি পদক্ষেপের চলমান পদক্ষেপগুলোর বাইরে নতুন করে তেমন কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের উৎসে কর, ভ্যাট ইত্যাদির কোনো ব্যবস্থা সেভাবে করা হয়নি।
তেলের দামের ক্ষেত্রে উৎসে কর, আগাম আয়কর ৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে স্পেসিফিক ডিউটি আরোপ করা হয়েছে। ফলে বাজারে তেল ও জ্বালানির মূল্য কমবে টা মনে হয় না। এছাড়া বিদ্যুতের মূল্য কমবে বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে আমদানিকৃত পণ্যের দাম কমলে সেটির সুফল দেশের ভোক্তারা পাবেন, সেই বিষয়টিও সুস্পষ্ট নয়।
আগামীতে টাকার মূল্যমান আরও পতন হলে সেটিকে আটকানোর জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেই বিষয়টিও পরিস্কার না। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতনের ব্যাপারে কোনো কিছু আলোকপাত করা হয়নি। একটি ফ্যামিলি কার্ড চালু করার কথা বহুদিন ধরে হচ্ছে।
সেবা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কী সম্প্রতি হলো তা বাজেটে নেই। উপরন্তু মোট সামষ্টিক সুরক্ষায় টাকার অঙ্কে ও অর্থনীতির হিসাব হিসেবে পরিমাণ কমে গেছে।
বিচলিত করার মতো বিষয়টি হলো দুই হাজার টাকার তথাকথিত নূন্যতম সার্বজনীন কর ধরা হয়েছে। এটা অন্যায়। ‘করযোগ্য আয় না থাকলে কেন কর দিতে হবে?’ যুক্তিতে এটা করা হয়েছে সেটি আমার কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। একটা সরকার ১৫ বছর দেশ শাসন করার পর দুর্বলতম অর্থ বছর নিয়ে নির্বাচনে যাচ্ছে। সেটিকে কাটিয়ে উঠার জন্য যে অভিনবত্ব, সৃষ্টিশীলতা দরকার, সেটি এই বাজেটে না দেখে হতাশ হয়েছি