গোলাম রাব্বানী
গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সব বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক, জেলা প্রশাসক (ডিসি), আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সুপাররা (এসপি) অংশ নেন। সকাল ১১টায় এ বৈঠক শুরু হয়ে তা দুপুরে শেষ হয়।
উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার ঠেকানো নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বৈঠক শেষেই তাৎক্ষণিকভাবে সিইসির কক্ষে জরুরি বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনাররা। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের ভোটে প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার চিন্তা করছে কমিশন। বিগত উপজেলা নির্বাচনেও এমন চিঠি দিয়েছিল ইসি। মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্যে যে কোনো মূল্যে উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু করার তাগিদ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, দেশে নির্বাচনে আবেগ-অনুভূতির জন্য কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। এ নির্বাচনে ব্যর্থ হলে বিগত (৭ জানুয়ারি) সংসদ নির্বাচনে যে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তা ক্ষুণœ হতে পারে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। উপজেলা নির্বাচনে আচরণবিধি অনুসরণ করতে মন্ত্রী-এমপিসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ইসি সচিব জাহাংগীর আলম। বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ অনুরোধ জনান। তিনি বলেন, প্রতি ইউনিয়নে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, প্রতি উপজেলায় দুই থেকে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বৈঠকে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তাদের মন্ত্রী-এমপিদের রোষানলে পড়তে হয়। মন্ত্রী-এমপিদের কথা না শুনলে ভোটের পড়েই বদলি করা হয় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের। তাই ভোটের পরের বদলি নিয়ে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। এ সময় নির্বাচন কমিশন বলেছে, আপনারা আপনাদের কাজ করবেন। মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রটেকশন দেওয়ার চেষ্টা করবে ইসি। এ ছাড়া পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভোটের পরে যদি কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়; তবে যেন তাকে ভালো কোন জায়গায় দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভোট কেন্দ্রে সকালে ব্যালট পাঠানোর জন্য বাড়তি বরাদ্দ রাখা; নির্বাচনের আগেই ভোটের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ দেওয়ার দাবিও জানান মাঠ কর্মকর্তারা। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, এবারে ধাপে ধাপে এক জেলায় একাধিক দিনে ভোট করার কারণে ভোটের পরিবেশ ঠিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুবিধা হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ করতে এক উপজেলা নির্বাচনে অন্য উপজেলা থেকে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যদের আনার পরামর্শ দেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। বৈঠকে বলা হয়, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও তাদের শতাধিক প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অনেক উপজেলায় তিন পদেই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী থাকায় সংশ্লিষ্ট উপজেলায় দলীয় কোন্দল দেখা দিয়েছে। এই কোন্দলের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্ন ঘটার শঙ্কা রয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার ষষ্ঠ উপজেলা ভোট নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের সভাও এই বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ওই সভায় চার নির্বাচন কমিশন, জননিরাপত্তা বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইসি সচিবের ব্রিফিং : বৈঠক শেষে ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে সমন্বয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচন উপহার যাতে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে আচরণবিধি অনুসরণে মন্ত্রী-এমপিসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। সবার আলোচনার বিষয় ছিল সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মাঠপর্যায়ে কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে, আর কী ধরনের সহায়তা দরকার, প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ জেলায় কী সমস্যা আছে তা বলেছেন। মন্ত্রী-এমপিরা প্রভাব খাটাচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে ইসি নজর রাখবে বলে জানান ইসি সচিব।
ইসি সচিব জানান, প্রতি ইউনিয়নে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, প্রতি উপজেলায় দুই থেকে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া প্রয়োজনে অতিরিক্ত জনবল দেওয়া হবে। জেলা কোর কমিটির চাহিদা থাকলে অতিরিক্ত ফোর্স দেওয়া হবে। সাধারণ কেন্দ্রে চারজন পুলিশ সদস্য, অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পাঁচজন সদস্য থাকবে। পার্বত্য জেলার নির্বাচনে সতর্কতার জন্য অধিক সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বলা হয়েছে। সচিব জানান, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ভোটের দিন সকালে ব্যালট গেলে যে অতিরিক্ত বাজেটের প্রয়োজন হবে, কমিশন তা বিবেচনা করবে বলে বৈঠকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে জাহাংগীর আলম বলেন, সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা (মাঠ প্রশাসন) যেভাবে নিরপেক্ষতা, সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে যে দায়িত্ব পালন করেছে, সেই ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত থাকে। কুষ্টিয়া ও সিলেটের দুই ইউপি চেয়ারম্যান পদত্যাগ না করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পদত্যাগ না করায় স্ব স্ব রিটার্নিং কর্মকর্তা তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। পরে ওই দুই চেয়ারম্যানের রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে মনোনয়নপত্র বাতিলের আদেশ স্থগিত করেছে হাই কোর্ট। এই দুই চেয়ারম্যানের প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে ইসি আপিল করবে বলে জানান সচিব জাহাংগীর। তিনি বলেন, মামলার আদেশের কপি এখনো পাইনি। পেলে আপিল করা হবে। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে দেড় শ উপজেলায় ভোট হবে আগামী ৮ মে। তবে প্রথম ধাপে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষে ভোটের আগেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৩৩ জন। নির্বাচনে তিন পদে এখন ভোটের মাঠে আছেন ১ হাজার ৬৯৩ জন প্রার্থী। দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে, তৃতীয় ধাপে ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপে ৫ জুন ভোট গ্রহণ হবে। সব মিলিয়ে অন্তত ৪৮৫ উপজেলার ভোট হবে চার ধাপে।