• Fri. Oct 18th, 2024

Basic News24.com

আমরা সত্য প্রকাশে আপোষহীন

বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন অন্তত ৫০ আওয়ামী লীগ নেতা

Bybasicnews

Sep 23, 2024

 

 ডেস্ক ॥ যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের অন্তত ৫০ নেতা। দেশ ছাড়ার তালিকায় প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার, সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন, প্রাক্তন মন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সাবেক সংসদ সদস্য রণজিৎ রায় (যশোর-৪), যশোর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, সাবেক সংসদ সদস্য এসএম কামাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নাম প্রকাশ করেছে ইংরেজি দৈনিক দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে দলের শীর্ষ নেতাকর্মীরা দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। অনেকেই স্থলপথ বা আকাশপথে পালানোর চেষ্টা করার সময় আটক হয়েছেন, আবার অনেকেই যশোর সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যেতে সফল হয়েছেন।

স্থানীয়, সরকারি এবং বেসরকারি সূত্র মতে, ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বেনাপোল ইমিগ্রেশনের প্রভাবশালী ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ করে’ আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক পদধারী নেতা-কর্মী ও সাবেক সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তারা ভারতে গেছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ থেকে সহজে বৈধ ও অবৈধপথে ভারতের বৃহৎ প্রবেশদ্বার যশোরের শার্শা সীমান্ত। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী এ সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।

সীমান্তপথে অবৈধভাবে যাওয়ার পাশাপাশি বেনাপোল ইমিগ্রেশনের প্রভাবশালী ও অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্ধশতাধিক পদধারী নেতাকর্মী ভারতে প্রবেশ করেছেন।

এছাড়া, স্থানীয় অবৈধ ঘাট নিয়ন্ত্রণকারীদের মাধ্যমে অসংখ্য শীর্ষ নেতা-কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন মামলার আসামিরাও দেশ ছেড়েছেন।

এই ব্যক্তিরা স্থানীয় চোরাচালান সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশে বা বেনাপোল ইমিগ্রেশনের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়েছেন এবং এই পালানোর জন্য তাদেরকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়েছে।

শার্শার পুটখালী, সাদিপুর এবং ঘিবা রুট- যা অবৈধ পারাপারের জন্য কুখ্যাত, সম্প্রতি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে। শার্শায় বনজঙ্গল পরিপূর্ণ প্রায় ৩০ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে। অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা এই পারাপারকে সহজতর করেছে, যেখানে স্থানীয় সিন্ডিকেটগুলো সহায়তা করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও চক্রটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানতে পেরেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

ঘিবা রুট দিয়ে মানবপাচারে জড়িত দুটি সিন্ডিকেট সদস্যের সাথে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। পত্রিকাটি তাদের সংবাদে উল্লেখ করেছে- নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়া হয়, অন্যদের জন্য ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চার্জ করা হয়।

তারা আরও উল্লেখ করেছেন, ভারতে পৌঁছানোর পর এসব ব্যক্তি কলকাতা এবং অন্যান্য অঞ্চলে হোটেল ও ফ্ল্যাট ভাড়া করে অবস্থান করছেন।

বেনাপোল বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেছে টিবিএস, তবে অনেকেই সম্ভাব্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

শার্শা উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য রুবেল হোসেন টিবিএসকে জানান, ‘কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের নেতাদের ভারতে পালাতে সাহায্য করছেন এবং বিপুল অর্থ আয় করছেন। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং পুলিশ কোনো মানবপাচারের ঘটনার কথা অস্বীকার করেছে এবং তারা দাবি করেছে যে সীমান্তে টহল আরও জোরদার করা হয়েছে।

ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এরপর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে, যার ফলে তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ সত্ত্বেও, অনেকেই বর্তমান প্রশাসনের নজর এড়িয়ে সফলভাবে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

অবৈধ পারাপার এখন নিরাপদ পালানোর পথ?

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করার সময় অনেকেই আটক হয়েছেন, তাই অবৈধ পারাপার নিরাপদ পালানোর পথ হয়ে উঠেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। বেনাপোল পোর্ট থানা এলাকার পুটখালী সীমান্ত মানবপাচার ও অবৈধ পারাপারের জন্য একটি জনপ্রিয় রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আরেকটি ব্যস্ত চোরাচালান রুট হলো ঘিবা রুট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ার কারণে এই দুই রুটের পরিবর্তে পেট্রাপোলের নিকটবর্তী সাদিপুর রুটটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনটি এলাকায় নদী সীমান্তকে পৃথক করেছে, নদী পার হলেই ঘন জঙ্গলে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্কের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত অভিযান চালাতে পারে না।

বর্তমানে পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সীমান্ত পার হতে সহায়তা করছে। প্রথমে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে একজন বা দুজনকে সাহায্য করা হলেও এটি এখন একটি বড় আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।

যশোর দিয়ে কে কে সীমান্ত পার হয়েছেন?

৫ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা বেনাপোল বা অবৈধ রুট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, যিনি বিরোধী নেতাকর্মীদের উপর কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য পরিচিত ছিলেন। একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, টিবিএসকে জানান যে, তিনি(বিপ্লব কুমার) এই সীমান্ত রুট দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন।

টানা চারবার শার্শার সংসদ সদস্য ছিলেন শেখ আফিল উদ্দিন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় শার্শার সীমান্তে চোরাচালান তার অনুসারীরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বেনাপোল পৌরসভার সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম লিটন টিবিএসকে জানান, শেখ আফিল উদ্দিনও তার চোরাচালান সিন্ডিকেটের সহায়তায় সীমান্ত পার হয়েছেন। এদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং খুলনার সাবেক সংসদ সদস্য এসএম কামালও শেখ আফিলের সহায়তায় ভারতে গেছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের ঘনিষ্ঠ এবং ‘ফার্মগেটের রাজা’ নামে পরিচিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরানও এ পথে ভারতে গেছেন। তাকে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মিলনের বিরুদ্ধে।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীন চাকলাদার পুটখালী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন। ঘিবা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী (মণিরামপুর-৫) স্বপন ভট্টাচার্য, সাবেক সংসদ সদস্য রণজিৎ রায় (যশোর-৪), যশোর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ, যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসেন।

ইমিগ্রেশন সিল ও স্বাক্ষর জালিয়াতি

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যে-সব নেতাকর্মী ও অপরাধী সীমান্তপথে ভারতে পালাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশের পাসপোর্ট ও ভিসা রয়েছে। তবে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দিলে ধরা পড়ার ভয়ে তারা অবৈধপথে সীমান্ত পার হচ্ছেন।

স্থানীয় সিন্ডিকেটের ওই দুই সদস্যও টিবিএসকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন মামলার আসামিদের সঙ্গে পাসপোর্ট রয়েছে। ইমিগ্রেশনে কড়াকড়ি থাকায় দালালচক্র পাসপোর্টে দুই দেশের ইমিগ্রেশন সিল ও সই নকল করে তাদের পাঠাচ্ছে বলে জানান ওই দুই ব্যক্তি। বিশ্বস্ত প্রেস থেকে এ নকল সিল তৈরি করে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এর ফলে অপরাধীরা নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। অন্যদিকে যাদের পাসপোর্ট-ভিসা নেই, তারা কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বেনাপোল ইমিগ্রেশনে গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশ, এনএসআই (ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি), এবং ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স) সদস্যরা সন্দেহভাজন পাসপোর্টধারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তবে সম্প্রতি সীমান্ত এলাকায় পুলিশি টহল খুব কম দেখা যাচ্ছে।

২৩ আগস্ট, শুল্ক সুপারিনটেনডেন্ট শিবলী নোমান এবং কামরুননাহার যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিব নওশাদ পল্লবকে ভারতে পালাতে সাহায্য করার জন্য একটি বন্ধ শুল্ক গেট খুলে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে বিজিবি পালানোর চেষ্টা করার সময় তাকে আটক করে। তবুও এই ঘটনার সাথে জড়িত কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস হাউজের সুপারিনটেনডেন্ট মোকলেসুর রহমান টিবিএসকে বলেন যে, ঊর্ধ্বতন কাস্টমস কর্মকর্তারা এই বিষয়ে তদন্ত করছেন। ঘটনাটির পর থেকে গেটটি সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে। বেনাপোল বিজিবি ক্যাপ্টেন সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, “ভারতে অপরাধীদের পালানো প্রতিরোধে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিজিবি সতর্ক রয়েছে, যাতে কোনো অপরাধী সীমান্ত রুট বা ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে পালাতে না পারে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *