• Fri. May 3rd, 2024

Basic News24.com

আমরা সত্য প্রকাশে আপোষহীন

২২০০ পিস ইয়াবা বদলে মাত্র ২০ ৩২০০ হয়ে যায় ৩২০ পিস!

Bybasicnews

Sep 10, 2022

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার একটি মাদক মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন সফিউল্লাহ খান। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর তিনি জামিন নেন। তার জামিনাদেশে মাত্র ২০ পিস ইয়াবা জব্দের কথা উল্লেখ করা হয়। এই জামিন আদেশে গোপালগঞ্জ কারাগার থেকে বেরিয়ে যান সফিউল্লাহ খান।

এদিকে সিলেটের জকিগঞ্জ থানার একটি মামলায় জব্দ হওয়া ৩২০০ পিস ইয়াবাকে ৩২০ পিস দেখিয়ে ২০২০ সালের ১২ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান আবদুস সালাম। ২০২০ সালের ১৯ মার্চ গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একটি চিঠি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, সফিউল্লাহর কাছ থেকে ২২০০ পিস ইয়াবা জব্দের কথা থাকলেও উচ্চ আদালতের আদেশনামায় ২০ পিস ইয়াবা জব্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট    গোপালগঞ্জ পৌর এলাকার লঞ্চঘাট ব্রিজ থেকে সফিউল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার দেহ তল্লাশি করে ২২০০ পিস ইয়াবা এবং ৩০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। ওইদিনই গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর-২৪। পরে একই বছরের ১৮ আগস্ট বিষয়টি এক প্রতিবেদনে জামিন আদেশ দেওয়া বেঞ্চকে অবহিত করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর জাল-জালিয়াতকারীদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের ওই বেঞ্চ মামলার আদেশ দেন।এই জাল-জালিয়াতির ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর উচ্চ আদালতের সহকারী রেজিস্ট্রার (ফৌজদারি-২) জাকির হোসেন পাটোয়ারী একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-২৫। পরবর্তীতে মামলাটির তদন্ত করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক সুলতান হোসেন। গত বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকার আদালতে দাখিল করা ওই মামলার চার্জশিট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সিআইডির তদন্তে এই জাল-জালিয়াতিতে জড়িত ১৫ জনের নাম বেরিয়ে আসে। তারা হলেন- সফিউল্লাহ খান, মনির হোসেন, কামরুল ইসলাম, আলী ফকির, মোকলেস মোল্লা, সিফাত মোল্লা, হীরা বেগম, হাছিনা বেগম, অ্যাডভোকেট এম এ আলম সেলিম ওরফে মো. এন্তেখাফ আলম সেলিম, অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান শেখ ও অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম পিন্টু। এরা সবাই পলাতক। এ ছাড়া জাকির হোসেন মোল্লা, জাহিদুল ইসলাম, তপন বিশ্বাস, অগস্তা বাইন জামিনে মুক্ত আছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোপালগঞ্জ সদর থানার মামলায় জামিন পেতে ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ আদালতে আবেদন করেন আসামি সফিউল্লাহ খান। বিচারক তার জামিন আবেদন না মঞ্জুর করেন। সফিউল্লাহর মামলাটি পরিচালনা করছিলেন তার স্ত্রী হাছিনা বেগম।

এদিকে সিআইডির পরিদর্শক সুলতান হোসেন তার তদন্তে উল্লেখ করেছেন, জামিন না মঞ্জুর হলে গোপালগঞ্জের আইনজীবীর সহকারী ওবায়দুর রহমান মোল্লা কারাগারে থাকা সফিউল্লাহকে জানান যে- জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে যেতে হবে। ২০১৮ সালের ৩০ জুন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানায় একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর- ৩৯। মাদকের ওই মামলার আসামি মোকলেস মোল্লা গ্রেফতার হয়ে সফিউল্লাহর সঙ্গেই কারাগারে আটক ছিলেন। সেখানে দুজনের পরিচয় হয়। সফিউল্লাহর জামিনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন মোকলেস। এতে সফিউল্লাহ রাজি হন। বিষয়টি জেল গেটে স্ত্রী হীরা বেগমকে জানান মোকলেস। পরে হীরা বেগম ও সফিউল্লাহর স্ত্রী হাছিনা বেগম আইনজীবীর সহকারী ওবায়দুর রহমান মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওবায়দুর খুলনার তেরখানা উপজেলার কাটেঙ্গা গ্রামের আলী ফকিরকে জামিনের বিষয়ে দায়িত্ব দেন। পূর্ব পরিচিত দাউদ মোল্লার সঙ্গে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কাটেঙ্গ গ্রামের একটি চায়ের দোকানে দেখা হয় আলী ফকিরের। তখন তিনি দাউদ মোল্লাকে বলেন- গোপালগঞ্জ আদালতের একটি ২২০০ পিস ইয়াবা মামলার আসামি সফিউল্লাহকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন করাতে হবে। ওই চায়ের দোকানে বসা একই গ্রামের ইউসুফ শেখ তাদের জানান, তার ভাগিনা কামরুল ইসলাম উচ্চ আদালতের উকিল। তখন কামরুল ইসলামের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন দাউদ মোল্লা। এরপর দাউদ মোল্লা ও আলী ফকির গোপালগঞ্জ আদালতে গিয়ে ওবায়দুরের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে নকলখানা থেকে সফিউল্লাহর নামে গোপালগঞ্জ সদর থানার মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা, ফরওয়ার্ডিং ও জামিন না মঞ্জুরের আদেশ সংগ্রহ করেন। পরে ওবায়দুর ২২০০ পিস ইয়াবার স্থলে ২০ পিস দেখিয়ে জাবেদা নকল তৈরি করে দাউদ মোল্লা ও আলী ফকিরের কাছে দেন। তারা ওই জাবেদার কাগজ খুলনায় গিয়ে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকায় কামরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ কাগজ নিয়ে কামরুল ইসলাম ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অপর আইনজীবী মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা বলেন। মোস্তফা কামালের গাড়িচালক মনির হোসেনকে দিয়ে আসামি সফিউল্লাহর পক্ষে এফিডেভিট করিয়ে জামিন আদেশ নেন। ওই আদেশ গোপালগঞ্জ আদালতে পাঠানো হয়। সেখানে ওবায়দুর রহমান মোল্লা, অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান হাবিব, সাইফুল ইসলাম পিন্টু ও স্থানীয় জামিনদার হিসেবে সফিউল্লাহর স্ত্রী হাছিনা বেগম ও সিফাত মোল্লা পরস্পর যোগসাজশে দ্রুত জামিনের ওকালতনামা দাখিল করলে আদালত তা গ্রহণ করে। এরপর সফিউল্লাহ কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। জামিন আদেশ নেওয়ার সময় সরবরাহ করা নকল কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে উচ্চ আদালত দেখতে পান গোপালগঞ্জ আদালতে জাবেদা নকল টাইপ করেছেন অগস্তা বাইন, সেখানে তুলনা সহকারী তপন বিশ্বাস, প্রধান তুলনাকারক জাহিদুল ইসলাম এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন মোল্লার সিল ও সই আছে। সিআইডি সূত্র জানায়, জালিয়াতি করে জামিন নেওয়া আসামি সফিউল্লাহর নামে গোপালগঞ্জ সদর ও টুঙ্গিপাড়া থানায় মাদকের মোট ৮টি মামলা আছে। মামলার নথি জালকারী দাউদ মোল্লার নামে দিঘলিয়া থানার ৪টি মামলাসহ মোট ৭টি মামলা আছে। এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, জামিন জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

এদিকে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা করেন উচ্চ আদালতের সহকারী রেজিস্ট্রার (ফৌজদারি-২) জাকির হোসেন পাটোয়ারী। মামলা নম্বর-২৩। মামলাটির তদন্ত করেন সিআইডির পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান।

জাকির হোসেন পাটোয়ারী মামলায় উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ থানায় ইয়াবা জব্দের ঘটনায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় আসামি করা হয় আবদুস সালাম ও আলী আহম্মেদকে। এদের মধ্যে ২০২০ সালের ১২ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন আবদুস সালাম। জামিন নেওয়ার সময় আবদুস সালাম তার কাছ থেকে ৩২০ পিস ইয়াবা জব্দের কথা তুলে ধরেন। অথচ তার কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৩২০০ পিস ইয়াবা জব্দ করে। তার এই জামিনের খবরে একই মামলার অপর আসামি আলী আহম্মেদ ২০২০ সালের ৯ আগস্ট উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। এ সময় তার দেওয়া কাগজপত্র পর্যালোচনা করে আদালত দেখেন যে আলী আহম্মেদ সঙ্গে আবদুস সালামের উত্থাপিত কাগজপত্র ভিন্ন ভিন্ন। একই বছরের ২৪ আগস্ট সিলেট আদালত থেকে ওই মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা ও ফরওয়ার্ডিং ঢাকায় উচ্চ আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়- জকিগঞ্জ থানার মামলাটি হয়েছিল ৭৮০০ পিস ইয়াবা জব্দের ঘটনায়। এর মধ্যে ৪৬০০ পিস জব্দ করা হয়েছিল আলী আহম্মেদের কাছ থেকে এবং ৩২০০ পিস জব্দ করা হয়েছিল আবদুস সালামের কাছ থেকে।

জাল-জালিয়াতি করে এমন জামিন নেওয়ার ঘটনায় মামলায় আবদুস সালাম, তার শ্বশুর ইমাম উদ্দীন, সিলেট আদালতের নকল বিভাগের প্রধান তুলনা সহকারী জসিম উদ্দিন, মোকাবিলা সহকারী অজিত কুমার মজুমদার, অনুলিপি সহকারী আতিকুর রহমান এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা খুরশীদ আলমকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ মামলায় আবদুস সালাম এবং তার শ্বশুর ইমাম উদ্দিনকে অভিযুক্ত করে চলতি বছরের গত ২৫ জুলাই আদালতে চার্জশিট দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান। জানা গেছে, জকিগঞ্জের মাদক মামলায় আবদুস সালামের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। আর ইমাম উদ্দিন এখনো পলাতক রয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *